বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস-এ দেশের আহলে হাদীস জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী মূল সংগঠন এবং ঐক্যবদ্ধ তাওহীদী প্লাটফর্ম। ১৯০৬ সালে ভারতবর্ষের উত্তর প্রদেশের আরায় এ উপমহাদেশের আহলে হাদীসদের প্রতিনিধিবৃন্দের ঐতিহাসিক সম্মেলনে গঠিত হয় ‘অল ইণ্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্স।’ সেই ধারাবাহিকতায় ১৯১৪ সালে বাংলার বিশিষ্ট আহলে হাদীস আলেমগণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আঞ্জুমানে আহলে হাদীস বাঙ্গালা।’ পরবর্তীতে এর সাথে আসামকেও সংযুক্ত করা হয়। ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত আহলে হাদীসদের খণ্ড খণ্ড জামাআতসমূহ যখন সংকটময় সময় অতিবাহিত করছিল, এমন এক সন্ধিক্ষণে আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহেল বাকী সভাপতিত্বে ১৯৪৬ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ এপ্রিল রংপুর জেলার হারাগাছ বন্দরে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক এক কনফারেন্স; আর এ কনফারেন্সে গঠিত হয় ‘নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলে হাদীস’ এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল কোরাইশী ।
কনফারেন্সের পর বাংলার তদানীন্তন রাজধানী কোলকাতার ১ নম্বর মারকুইস লেনের মিসরীগঞ্জ আহলে হাদীস জামে মাসজিদে জমঈয়তের সদর দফতর স্থাপিত হয়। দেশ বিভাগের ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কোলকাতার মিসরীগঞ্জ মাসজিদে অনুষ্ঠিত জেনারেল কমিটির সভায় জমঈয়তের দফতর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পাবনায় স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরই পরিপেক্ষিতে সে বছর ৭ মার্চ পাবনায় জমঈয়তের অফিস উদ্বোধন করা হয়। ১৯৪৮ সালের ২ জুলাই পাবনায় জমঈয়তের জেনারেল কমিটির সভায় ‘আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল কোরায়শী রচিত জমঈয়তের গঠনতন্ত্র অনুমোদিত হয়। অতঃপর উক্ত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী শাখা, ইলাকা ও জেলা জমঈয়ত গঠনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
দেশ বিভাগজনিত কারণে পরবর্তীতে উপমহাদেশে অঞ্চল ভিত্তিক জমঈয়তে আহলে হাদীসের নামকরণ করা হয়। যেমন-পূর্বপাক জমঈয়তে আহলে হাদীস, পশ্চিমবঙ্গ জমঈয়তে আহলে হাদীস, অল ইণ্ডিয়া জমঈয়তে আহলে হাদীস, পশ্চিম পাকিস্তান জমঈয়তে আহলে হাদীস, আসাম জমঈয়তে আহলে হাদীস এবং নেপাল জমঈয়তে আহলে হাদীস। ১৯৪৯ সালের ২৭ মে পাবনায় ‘আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহেল বাকী জমঈয়তের মুদ্রণ ও প্রকাশনা সংস্থা ‘আল হাদীস প্রিন্টিং এণ্ড পাবলিশিং হাউজ’ এর দ্বারোদঘাটন করেন। একই বছরে অক্টোবর মাসে জমঈয়তের মুখপত্ররূপে “মাসিক তর্জুমানুল হাদীস”-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন স্বয়ং ‘আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল কুরায়শী। ১৯৫৩ সালের ১০ ডিসেম্বরে পাবনায় অনুষ্ঠিত জেনারেল কমিটির সভায় নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলে হাদীসের নতুন নামকরণ করা হয় “পূর্ব পাকিস্তান জমঈয়তে আহলে হাদীস।”
একইসময়ে ‘আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল কুরায়শীর নেতৃত্বে ইসলামপন্থী দলগুলোর সমন্বয়ে এক সাফল্যমণ্ডিত ‘ইসলামী ঐক্যফ্রন্ট’ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে জমঈয়তের দফতর পাবনা হতে ঢাকায় স্থানান্তরের পর হতে ১৯৬০ সালের ৪ জুন জমঈয়তের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ‘আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরায়শীর ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত সময়টি জমঈয়তের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। মাসিক তর্জুমানুল হাদীস-এর প্রকাশনা অব্যাহত রেখেই ১৯৫৭ সালের ৭ অক্টোবর মুসলিম সংহতির দৃপ্ত নকীবরূপে ‘সাপ্তাহিক আরাফাত’-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। যোগ্য আলেম তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৫৯ সালে দিল্লীর রাহমানিয়া মাদরাসার আদলে ঢাকার কাজী আলাউদ্দীন রোড-নাজির বাজারে প্রতিষ্ঠা করেন মাদরাসাতুল হাদীস।
আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরায়শীর ইনতিকালের পর ১৫ জুন, ১৯৬০ সালে জমঈয়তের কার্যকরী কমিটির সভায় ‘প্রফেসর আল্লামা ড. মুহাম্মদ আব্দুল বারী পূর্ব-পাকিস্তান জমঈয়তে আহলে হাদীসের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং পরবর্তী জেনারেল কমিটির সভায় উক্ত নিবার্চন সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জমঈয়ত তার বিভিন্নমুখী কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখে। সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয় এবং ‘আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী-সহ প্রতিষ্ঠিত উলামায়ে কিরামের মূল্যবান গ্রন্থও এ সময়ে প্রকাশ করা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর পূর্ব-পাকিস্তান জমঈয়তে আহলে হাদীস-এর নাম পরিবর্তন করে নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস।’ স্বাধীন দেশে আল্লামা ড. মুহাম্মদ আব্দুল বারীর নেতৃত্বে জমঈয়তে আহলে হাদীসের কাজ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলে। ইতোমধ্যে ১৯৭৮ সালে পুরাতন ঢাকার ৮৬, কাজী আলাউদ্দীন রোডে স্থাপিত জমঈয়ত কার্যালয় দুঃখজনকভাবে ত্যাগ করতে হয়। ইত্যবসরে ঢাকার জমঈয়ত হিতৈষী ব্যক্তিত্ব আলহাজ্জ আব্দুল মাজেদ সরদার-এর আন্তরিক সহযোগিতায় ৯৮, নবাবপুর রোডে ৫ কাঠা জমি খরিদ করা হয়। তার অব্যবহিত পর একই প্লটের অবশিষ্ট ৫ কাঠা জমি বাংলাদেশ সরকারের নিকট হতে জমঈয়তের নামে লীজ গ্রহণ করা হয়। প্রায় একই সময়ে ঢাকা উত্তর যাত্রাবাড়ীতে জমঈয়তের নামে ২৬ কাঠা জমি এবং মাদ্রাসা মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়ার নামে ১৭ কাঠা জমি ক্রয় করা হয়। যেখানে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ সালাফী কওমী মাদ্রাসা। ‘আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল কুরায়শী , ‘আল্লামা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ ও ‘আল্লামা ড. মুহাম্মাদ আবদুল বারী-এর গ্রন্থাগার এখানেই স্থান পেয়েছে।
১৯৭৮-১৯৮৩ সালের মধ্যে সাউদী সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক মানের একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সাভার উপজেলার বাইপাইলে জমঈয়তের নামে ক্রয় করা হয় ৫২ বিঘা সম্পত্তি।
জমঈয়তে আহলে হাদীসকে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে সুপ্রতিষ্ঠিত করে ২০০৩ সালে ৪ জুন দুনিয়া থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন দীর্ঘ ৪৩ বছরের সফল সভাপতি অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব প্রফেসর আল্লামা ড. মুহাম্মদ আব্দুল বারী। এ সময়টি ছিল জমঈয়তের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এরপর একে একে জমঈয়তের দায়িত্ব পালন করেন প্রফেসর এ কে এম শামসুল আলম (২০০৪-২০১০), প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইলিয়াস আলী (২০১০-২০১৬), অধ্যাপক মুহাম্মদ মোবারক আলী (২০১৬-২০২০), প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আযহার উদ-দীন (২০২০-২০২১) এবং ২০২১ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ ফারুক।
এক নজরে আমাদের অর্জন:
এ দেশের আহলে হাদীস তথা কুরআন ও সহীহ হাদীসের একনিষ্ঠ অনুসারীদের তাওহীদী সংগঠন বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস। বিগত প্রায় আট দশকব্যাপী এ সংগঠনটি কুরআন-সুন্নাহ’র দা‘ওয়াহ্ ও তাবলীগের পাশাপাশি দীনী প্রতিষ্ঠান পরিচালনাসহ আর্তমানবতার সেবায় নিরন্তর কাজ করে আসছে এবং এ কাজে উত্তরোত্তর গতি সঞ্চারিত হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকার অদূরে বাইপাইল, আশুলিয়ায় জমঈয়তের নিজস্ব জায়গায় প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ইয়াতীমখানার বহুতল ভবনের দ্বিতীয় তলার কাজ সম্পন্ন হয়ে তৃতীয় তলার কাজ শুরু হয়েছে আল-হামদুলিল্লাহ। আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল কুরাইশী (রাহিমাহুল্লাহ) মডেল মাদরাসা’র শিক্ষার মান ও ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আরোও একটি ভবন নিমার্ণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে সেইসাথে ছাত্রীদের অভিভাবকদের জোরালো দাবীর প্রেক্ষিতে মডেল মাদরাসার বালিকা শাখা চালু করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি-র ভবনের কাজও সম্পন্ন হয়েছে এবং অতি শীঘ্রই শিক্ষা কার্যক্রম চালু হবে বলে আমরা আশাবাদী- ইন শা আল্লাহ। এছাড়া বাইপাইলে একটি বিশ্বমানের উচ্চতর ক্বাওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠারও পরিকল্পনা রয়েছে। যাত্রাবাড়ী-ঢাকায় অবস্থিত বহুতল বিশিষ্ট জমঈয়ত ভবনের ৮ম তলার কাজও চলমান। ৯৮ নবাবপুর রোড, ঢাকায় ‘জমঈয়ত টাওয়ার’ নির্মাণের কাজ প্রক্রিয়াধীন এবং ভাওরাইদ-গাজীপুরে নওমুসলিম প্রকল্পের অধিবাসীদের কল্যাণার্থে আলহাজ্জ এ কে এম রহমত উল্লাহ এম.পি মহোদয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় সাহায্য ও সহযোগিত অব্যাহত রয়েছে। এ সংগঠনের মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক আরাফাত’ ও ‘মাসিক তর্জুমানুল হাদীস’ সমৃদ্ধ কলেবরে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে এবং জমঈয়ত পরিচালিত ‘বাংলাদেশ আহলে হাদীস তা‘লীমী বোর্ড ঢাকা’-এর কার্যক্রমও যথাযথ এগিয়ে চলেছে।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও রামাযানকে ঘিরে দেশব্যাপী দাওয়াহ-তাবলীগী এবং সাংগঠনিক কর্মসূচী বাস্তবায়নে প্রস্তুতি গ্রহন করা হয়েছে। এ সকল বহুমুখী কার্যক্রম ফলপ্রসূ হচ্ছে প্রথমত: আল্লাহ তা‘আলার মেহেরবানী, অতঃপর আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতায়। আর তা অব্যাহত রাখতে এবারও আপনারা এগিয়ে আসবেন, সম্প্রসারিত করবেন আপনাদের দানের হাত এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদের সৎ ‘আমলসমূহ কবূল করুন আমীন।