বিদআতের সরলাংক
লেখক: শাইখ আবু আদেল মুহাম্মাদ হারুন হুসাইন, সম্পাদক-সাপ্তাহিক আরাফাত।
সিনিয়র যুগ্ম সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস।
বিদআত কি?
বিদআত ঐ সমস্ত ‘আমলকে বলা হয়, যা মানুষ দ্বীন মনে করে সাওয়াবের আশায় পালন করে; অথচ এটার সমর্থন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কোনো হাদীসে নেই। এমনকি সাহাবায়ে কিরাম, তাবেঈনে এযাম ও স্বর্ণ যুগের কেউ তা পালন করেননি। ইমাম শত্বেবী বলেন: মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় দ্বীনের নামে এমন কোনো প্রথা/‘আমল চালু করার নাম বিদআত, যা কোনো মৌলিক বা গৌণ শরঈ দলিলের উপর ভিত্তিশীল নয়। [১]
হাফেয ইবনু রজব বলেন:
فكل من أحدث شيئا و نسبه إلى الدين، و لم يكن له أصل من الدين يرجع إليه، فهو ضلالة.
“(বিদআত হলো) এমনসব নতুন বিষয় যা কেউ তৈরি করে দ্বীনের প্রতি সম্মন্ধ করে, অথচ তার শরিয়তে কোনো ভিত্তি নেই যার দিকে প্রত্যাবর্তন করা হবে। সেটি গুমরাহী।” [২]
অর্থাৎ-এমন ‘আক্বিদাহ্ ও ‘আমলের আবিষ্কার করা, যা কুরআন ও সহীহ হাদীসে নেই।
বিদআতের পরিণাম:
বিদআত দু‘প্রকার। এক-‘আক্বীদাহগত বিদআত। দুই-‘আমলে বিদআত।
‘আক্বীদাহ্গত বিদআত ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। উদাহরণস্বরপ বলা যায়: রাফেজী শিয়া, মু‘তাযিলা, আশ‘আরী ও মাদুরিদী ইত্যাদি মতবাদসমূহ। পরবর্তীতে এর সাথে যোগ দেয় ‘ইল্মে তাসাউফ এর নামে সূফী-সন্যাসীদের সৃষ্টি নানাহ ভ্রান্তিমূলক ‘আক্বিদাহ্। পক্ষান্তরে ‘আমলের মাঝে সৃষ্টি বিদআতসমূহও অতি মারাত্মক। এসব বিদআতের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো মীলাদ মাহফিল, কুরআনখানি, ইমাম মুসল্লি মিলে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত শেষে সম্মিলিত দু‘আ মুনাজাত করা, শবেবরাত পালন, সে রাতে হালুয়া রুটি খাওয়া দলে দলে কবর যিয়ারত করা, কুলখানি ও মৃত্যু দিবস পালন এবং বিভিন্ন প্রকার খতম পড়া ইত্যাদি। তবে মীলাদ মাহফিলে রাসূল (সাঃ) হাজির হন এ বিশ্বাসে দাঁড়িয়ে ক্বিয়াম করা ‘আক্বীদাহ্গত বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। বিদআতের পরিণাম অতি ভয়াবহ। নিম্নে বিশেষ কয়েকটি পরিণাম স্ব-প্রমাণ উল্লেখ করা হলো-
১. ‘আমল প্রত্যাখ্যাত হবে :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِيْنَ أَعْمَالًا اَلَّذِيْنَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِيْ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُوْنَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُوْنَ صُنْعًا أُوْلَئِكَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ وَلِقَائِهِ فَحَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَلَا نُقِيْمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا﴾
অর্থ : “বলো, আমি কি তোমাদেরকে সেসব লোকদের সংবাদ দেব, যারা ‘আমলের দিক দিয়ে খুবই ক্ষতিগস্ত। তার সেই লোক, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনে বিভ্রান্ত হয়; অথচ তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করছে। তারাতো সেই লোক, যারা তাদের রবের নিদর্শনাবলী এবং তাঁর সাথে সাক্ষাতের বিষয় অস্বীকার করে। ফলে তাদের ‘আমলসমূহ বাতিল হয়ে যায়। সুতরাং ক্বিয়ামত দিবসে আমি তাদের কোনো ওজরই (গুরুত্ব দেব না) গ্রহণ করব না।” [৩]
এ প্রসঙ্গে রাসূল (সাঃ) বলেন:
مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ، فَهُوَ رَدٌّ
“যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনে নতুন কিছু আবিষ্কার করল, যা তাতে নেই তা প্রত্যাখ্যাত।” [৪]
অপর বর্ণনায় এসেছে রাসূল (সাঃ) ইরশাদ ফরমান :
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
“যে ব্যক্তি এমন কোনো ‘আমল করল, যাতে আমাদের কোনো হুকুম নেই-তা প্রত্যাখ্যাত।” [৫]
২. রাসূল (সাঃ)-এর উম্মতের তালিকা বহির্ভুত :
রাসূল (সাঃ) বিদআতিকে তাঁর উম্মাত বহির্ভুত বলে আখ্যা দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে
مَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ.
“যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত হতে মুখ মুড়িয়ে নিলো, সে আমার উম্মাতভুক্ত নয়।” [৬]
উপরোক্ত দৃঢ়তাব্যঞ্জক বাণীটি রাসূল (সাঃ) কখন করেছিলেন? কখন এতবড় ধমক দিলেন যে, তাঁর সুন্নাত থেকে মুখ ফিরালে আর তাঁর উম্মত বলে দাবী করা যাবে না? উল্লেখিত হাদীসখানা, যা আমরা দলিল হিসেবে পেশ করেছি তা সাহাবী আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হাদীসের শেষাংশে। মা ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-কে রাসূল (সাঃ)-এর ‘আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতঃ যে, তিন সাহাবী যথাক্রমে সারারাত জেগে জেগে সালাত আদায়, যুগভর সিয়াম পালন ও বিবাহ না করার সংকল্প করেছিলেন। তাঁদের এ সংকল্প রাসূল (সাঃ)-এর সুন্নাতের বাইরে হওয়ার কারণ তাঁদের প্রতি তিনি (সাঃ) এ কঠিন ধমক দিয়েছিলেন। ভেবে দেখুন! মীলাদ যার ভিত্তিই শরিয়তে নেই, তা করলে কী পরিণাম হবে?
৩. তাওবাহ্ ক্ববুল না হওয়া :
বিদআত না ছাড়া পর্যন্ত বিদআতীর তাওবাহ্ ক্ববুল হবে না। এ মর্মে সাহাবী আনাস (রাঃ) রাসূল (সাঃ) হতে বর্ণনা করেন। রাসূল (সাঃ) বলেন :
إن الله احتجز التوبة عن صاحب كل بدعة.
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সকল বিদআতী হতে তাওবাহ্ বন্ধ করে দিয়েছেন।” [৭]
৪. হাউজে কাউসার থেকে বঞ্চিত হওয়া :
রাসূল (সাঃ)-কে আল্লাহ তা‘আলা যে বিশেষ নিয়ামত দ্বারা বিশেষত্ব দান করেছেন, তন্মধ্যে হাউজে কাউসার অন্যতম। রোজ কিয়ামতে তাঁর উম্মতেরা সে হাউজ থেকে পানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করবেন। কিন্তু বিদআতীরা এ নিয়ামত হতে বঞ্চিত হবে। এদের জন্য এর চেয়ে বড় আফসোস আর কী হতে পারে? সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ ফরমান :
“أَنَا فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ، وَلَيُرْفَعَنَّ مَعِيْ رِجَالٌ مِنْكُمْ ثُمَّ لَيُخْتَلَجُنَّ دُوْنِيْ، فَأَقُوْلُ : يَا رَبِّ أَصْحَابِيْ، إِنَّكَ لَا تَدْرِيْ مَا أَحْدَثُوْا بَعْدَكَ”.
“আমি হাউজে (উম্মতের জন্য আগেই) অপেক্ষমাণ থাকব। আর তোমাদের কিছু লোককে পেশ করা হবে। অতঃপর আমর নিকটে আসলে পর্দা দ্বারা আটকে দেয়া হবে। তখন আমি বলব: হে রব! আমার অনুসারী। আমাকে বলা হবে: তুমি (এদের সম্পর্কে) জানো না, তোমার পরে এরা কি বিদআত সৃষ্টি করেছ?” [৮]
৫. গোমরাহী ও জাহান্নাম অবধারিত:
রাসূল (সাঃ)-এর সুন্নাত ছেড়ে দিয়ে যারা বিদআতের প্রচলন ঘটায়, তারা যে পথভ্রষ্ট তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আল্লাহ তা‘আলা এদের পরিণাম সম্পর্কে বলেন :
﴿وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيْرًا﴾
“যে কেউ রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে তার নিকট সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পর সে মু’মিনদের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে থাকে। আমি তাকে সে পথেই ফিরিয়ে দেব যে দিকে সে ফিরিছে এবং আমি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাব, আর তা কতই না নিকৃষ্ট গন্তব্যস্থল।” [৯]
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وُجُوْهٌ يَوْمَئِذٍ خَاشِعَةٌ عَامِلَةٌ نَاصِبَةٌ تَصْلَى نَارًا حَامِيَةً﴾
“অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে লাঞ্ছিত। অধিক ‘আমলে পরিশ্রান্ত, ক্লিষ্ট, ক্লান্ত। তারা জ্বলন্ত আগুনে পতিত হবে।” [১০]
কেন সেই পরিণতি এ জন্য তারা দুনিয়ায় ভ্রান্ত পথের ‘আমল করত। ‘আমল করে ক্লান্ত হয়ে পড়তে, কিন্তু এ ‘আমলই তাদেরকে জাহান্নামে ফেলে দেবে। এ সম্পর্কে প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন:
وَشَرَّ الأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا، وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ
“আর নতুন আবিষ্কৃত নিকৃষ্ট। আর প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী।” [১১]
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সকল প্রকার বিদআত হতে বিরত থাকার তাওফীক দিন আমীন।
[১] আল-ইতেসাম- ইমাম শাত্বেবী, ১/৩৭।
[২] ইবনু রজব (জামেউল উলূমি ওয়াল হিকাম) তাহ্ক্বীক্ব-শু‘আয়েব আল আরনাউত্ব ও ইব্রাহীম বাজিস, মুআস্সাতুর রিসালাহ বাইরুত (৬ষ্ট সংষ্করণ) ২/১২৮।
[৩] সূরা আল-কাহফ: ১০৩-১০৫।
[৪] সহীহুল বুখারী-ফাতহ, ৫/২৬৯৭, মা. শা., হা. ২৬৯৭; সহীহ মুসলিম- হা. ১৭১৮।
[৫] সহীহুল বুখারী-৩/৬৯, ৯/১০৭ ও সহীহ মুসলিম- হা. ১৮/১৭১৮।
[৬] সহীহুল বুখারী-হা. ৫০৬৩; সহীহ মুসলিম- হা. ১৪০১।
[৭] সিলসিলাতুস্ সাহীহাহ্- আলবানী, হা. ১৬৬০।
[৮]. সহীহুল বুখারী-হা. ৬৫৭৬; সহীহ মুসলিম- হা. ২২৯৭।
[৯]. সূরা আন্ নিসা: ১১৫।
[১০] সূরা আল গা-শিয়াহ্: ১১৫।
[১১] সহীহ মুসলিম-হা. ৮৬৭; সুনান আবূ দাঊদ-হা. ৪৬০৭।