জিজ্ঞাসা (৪৫): সাত ভাগে কুরবানী করা যাবে কি? [রবিউল আলম, টঙ্গী, গাজীপুর]
জবাব: উট ও গরুতে শরীক হওয়া নবী (সাঃ)-এর একাধিক বিশুদ্ধ হাদীস ও সালাফে সালেহীনের বাণী দ্বারা সুপ্রমাণিত। নিম্নে সে সম্পর্কে নবী (সাঃ)-এর কতিপয় হাদীস ও সালাফে সালেহীনের বাণী পেশ করা হলো
(১) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমরা আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম এমতাবস্থায় কুরবানীর ঈদ উপস্থিত হলো। তখন আমরা গরুতে সাতজন ও উটে দশজন করে শরিক হলাম। (জামে‘ আত্ তিরমিযী-হা. ১৫০১)
(২) জাবির ইবনু ‘আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে ‘উমরাহ্ দ্বারা উপকৃত হতাম। তখন আমরা একটি গরু সাত জনের পক্ষ থেকে যবেহ করতাম, এভাবে আমরা তাতে শরিক হতাম। (সহীহ মুসলিম-হা. ১৩১৮)
(৩) জাবির ইবনু ‘আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা হুদায়বিয়ার বছরে উট সাতজনের পক্ষ থেকে এবং গরু ও সাতজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছিলাম। (সহীহ মুসলিম-হা. ১৩১৮)
উপরোক্ত হাদীসগুলোকে দলিল হিসাবে উল্লেখ করে কেউ কেউ বলে থাকেন যে, কুরবানীতে শরিক হওয়া সফরের এবং হজ্জের সাথে খাস। কারণ উপরের হাদীসগুলোতে সফরের কথা এসেছে।
আলেমগণের মতে উক্ত বর্ণনাগুলোতে সফরের কথা থাকলেও সেখানে একথা আসেনি যে, উক্ত শরীক কুরবানী সফরের সাথেই খাস ও মুকীম অবস্থায় চলবে না। কারণ
(১) মুহাদ্দিসীনে কিরামের অনেকেই উক্ত হাদীসগুলো সাধারণভাবে কুরবানীর অধ্যায়ে এনেছেন। কিন্তু তাঁরা বিষয়টিকে সফরের সাথে খাস করেননি। এ থেকেও বুঝা যায় যে, তারা ঐসব হাদীসকে এমনি সফর বা হজ্জের সফরের সাথে খাস হওয়া মনে করেননি।
(২) হাদীসের ব্যাখ্যাকারগণও এসব হাদীসকে সফরের সাথে খাস করেননি। আল্লামা আযীমা বাদী, শাইখ আব্দুর রহমান মুবারকপুরী, শাইখ ওবায়দুল্লাহ রহমানী তাঁরা কেউই উক্ত কুরবানীতে শরীক সম্পর্কিত হাদীসগুলোকে সফরের সাথে খাস করেননি।
(৩) শরীক কুরবানীকে সফরে সংগঠিত হওয়ার জন্য তার সাথেই খাস করলে যত কিছু নবী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কিরাম কর্তৃক সফরে ঘটেছে তার সবগুলোকেই ঐ সফরের সাথে খাস করা দরকার। আর এ অবস্থায় শরীয়াতের বহু মাসায়েল ‘আমল থেকে বাদ পড়ে যাবে।
(৪) কুরবানীতে শরিক হওয়া যে সফরের সাথে খাস নয় তার প্রমাণে আরো একাধিক হাদীস ও সাহাবীদের উক্তি রয়েছে।
‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন কুরবানীর ক্ষেত্রে একটি গরু সাতজনের পক্ষ থেকে এবং একটি উট সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট। (সহীহুল জামে‘ আস্ সগীর-হা. ২৮৯০)
অত্র হাদীসটি নবীর কওলী (বাচনিক) হাদীস যেখানে তিনি সফরের কথা মোটেই উল্লেখ না করে ব্যাপকভাবে বলেছেন, কুরবানীর ক্ষেত্রে গরুতে সাতজনের পক্ষ থেকে এবং উটে সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট।
(৫) শাবী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি ইবনু ‘উমার (রাঃ)-কে প্রশ্ন করলাম, বললাম: উট ও গরু কি সাতজনের পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়া যাবে? তিনি বললেন : হে শাবী! তার কি সাতটি আত্মা আছে? শাবী বলেন, আমি বললাম, মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর (অন্যান্য) সাহাবীগণ তো বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উটকে সাতজনের পক্ষ থেকে এবং গরুকেও সাতজনের পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়া মাসনুন করেছেন। এটা ইবনু ‘উমার এক ব্যক্তিকে বললেন : এরকমই কি তারা বলেন হে ওমুক? লোকটি বলল জি, হ্যাঁ। ইবনু ‘উমার তখন বললেন: এটা তবে আমি অনুধাবন করতে পারিনি। (মুসনাদ আহমাদ; ইমাম হায়সামী বলেন : হাদীসটির রিজাল তথা রাবীগণ সহীহ [সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম] গ্রন্থের রাবী। মাজমাউয যাওয়ায়েদ-৩/২২৬)
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, একটি কুরবানীর গরুতে অথবা উটে সাত পরিবারের সাতজন কিংবা একই পরিবারের সাতজনের অংশ গ্রহণ করা বৈধ। যদিও সাতজনের কারো ইচ্ছা কুরবানী না হয়; বরং শুধু গোশ্ত খাওয়ার ইচ্ছা হয়। বাকিদের অংশ কুরবানী হিসেবে বৈধ হবে। এটা মানতের কুরবানী হোক অথবা মুস্তাহাব (ঈদের) কুরবানী হোক। এটাই ইমাম শাফেঈ, আহমাদ এবং অধিকাংশ আলেমের মত। এক্ষেত্রে গোশ্ত ওয়ালার নিয়ত বাকি অংশীদারদের নিয়তের উপর প্রভাবহীন। (দেখুন : আল-মাজমু‘-৮/৩৭২)
ভাগে গরু কুরবানী দেয়ার বিষয়ে সৌদি আরবের উলামা পরিষদের স্থায়ী কমিটির ফাতাওয়া : ভাগে কুরবানী দেয়ার ব্যাপারে স্থায়ী কমিটিকে জিজ্ঞাসা করা হলে কমিটির সদস্যগণ এই জবাব প্রদান করেছেন যে, কুরবানীতে একটি গরু বা একটি উট সাতজনের পক্ষ হতে যথেষ্ট। এই সাতজন লোক একই পরিবারভুক্ত হোক অথবা আলাদা আলাদা সাত পরিবারের লোক হোক। চাই এই সদস্যদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকুক আর নাই থাকুক। কেননা নবী (সাঃ)-এর সাহাবীদের একাধিক লোক মিলে উট বা গরু কুরবানী দেয়ার অনুমতি দিয়েছেন। তাদের মাঝে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকতে হবে কিনা এমন কোনো কথা বলেননি। (লাজনায়ে দায়িমা’র কথা এখানেই শেষ)
ইসলাম ওয়েবের প্রশ্নোত্তর বিভাগে এই প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, সাতজনের কম লোক মিলে গরু কুরবানী দিতে পারবে কি না? জবাবে বলা হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। একটি গরুতে সাতজনের অংশগ্রহণ করা জায়িয আছে। (দেখুন: প্রশ্ন নং ৪৫৭৫৭)
সাতজনের অংশগ্রহণ জায়িয হলে সাতজনের কমের অংশগ্রহণ আরো উত্তমভাবেই জায়িয হবে। জামে‘ আত্ তিরমিযীর ভাষ্যকার আল্লামা আব্দুর রাহমান মোবারকপুরী (রহঃ) বলেন, আমি বলছি, হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে যে, রাসূল (সাঃ)-এর যামানায় সাহাবীগণ উট ও গরুতে অংশগ্রহণ করতেন। এমনিভাবে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তারা একটি ছাগলেও অংশগ্রহণ করতেন। তবে ছাগলে অংশগ্রহণের বিষয়টি একই পরিবারের সাত সদস্যের মধ্যে সীমিত। আর গরুতে সাত পরিবারের সাতজনের অংশগ্রহণ জায়িয। (দেখুন : তুহফাতুল আহওয়াযী-৪/১৫৯)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদের সকলকে বুঝার তাওফীক্ব দান করুন এবং তাক্বলীদমুক্ত হয়ে কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী ‘আমল করার তাওফীক্ব দান করুন আমীন।